টেলিভিশন এবং ইন্টারনেট ভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে আধুনিক বিশ্ব একটি গ্লোবাল ভিলেজ – “বিশ্বগ্রামে” পরিনত হয়েছে। বিশ্বের যে কোন প্রান্তে বসে অপর প্রান্তে বসবাসকারী মানুষদের জীবন আচরন, শিল্প সাহিত্য এবং সংস্কৃতি চর্চা সম্পর্কে খোজ খবর রাখা যাচ্ছে খুব সহযেই। প্রতিটি নতুনত্বের কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ নিজেদের শিল্প সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে তুলে ধরছেন সারা পৃথিবীর সামনে। আবার কেউ কেউ অন্যের সংস্কৃতিক চর্চার প্রতি বেশী অনুরক্ত হতে যেয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি এবং সাহিত্য চর্চা ভুলতে বসেছে।
স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণদের অনেকের ক্ষেত্রেই আমাদের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতি যেমন বাউল গান, জারি গান, সারিগান, কবিগান, মঞ্চনাটক কিংবা পুথিপাঠ সামনে বসে শোনার কিংবা দেখার অভিজ্ঞতা নেই। তবুও ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে প্রচলিত লোকগান ভাইরাল হয়ে যাবার ঘটনাগুলো একটা বিশেষ বিষয়কে ইংগিত করে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, সাহিত্য, কবিতা কিংবা গানের প্রতি আমাদের আত্মিক মমত্ববোধ লুকিয়ে রয়েছে। চর্চার অভাবে সেটির উপযুক্ত প্রকাশ ঘটছে না।
অনেক ক্ষেত্রেই লোকসংস্কৃতি চর্চার সাথে যুক্ত মানুষগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তারা প্রত্যেকেই স্বশিক্ষিত, প্রকৃতি আর সমাজ বিবর্তনের ধারা থেকে জীবন সম্পর্কে নানা শিক্ষা অর্জন করে থাকেন। তাদের উপলব্ধিগুলো প্রকাশ পেতে থাকে লোকসাহিত্যের পরতে পরতে। আবহমান বাংলার আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা এই সাহিত্য ভান্ডারের খবর অনেকের কাছেই অজানা ছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে গ্রামোফোন (১৮৮৭ সাল ) এবং রেডিও (১৯০০ সাল) আবিস্কারের সাথে সাথে নতুন ভাবে লোকসাহিত্যের সাথে পরিচিত হতে থাকে আমাদের সভ্যতা।
বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে ব্যপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমেদ। এই ক্ষেত্রে কোলকাতা বেতার এবং গ্রামোফোন রেকর্ডিং কোম্পানী এই এম ভি’র ভূমিকা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। একবিংশ শতাব্দীতে এসে প্রায় ১০০ বছর পরেও আব্বাস উদ্দিনে কন্ঠে গাওয়া গানগুলো আমাদেরকে নস্টালজিক করে দেয়। লোকসুর গুলোকে মনে যেন হাজার বছরের চেনাসুর, নিজেদের একান্ত আপন আর ভালবাসার সুর। আব্বাস উদ্দিনে গানে দোতারার একটা বিশেষ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। দোতারার যাদুকর কানাই লাল শীলের দোতারার যাদুতে আব্বাস উদ্দিন গানগুলো অনেক বেশী জীবন্ত আর সতেজ মনে হয়।
আমরা ( ঢাকা এবং কোলকাতার বেশ কিছু তরুণ) আব্বাস উদ্দীনের গান নিয়ে পড়াশুনা করছিলাম দীর্ঘদিন ধরে। দোতারার বাদনশৈলি এবং সুরের বিশেষ ঢং আমাদেরকে দারুন ভাবে আকৃষ্ট করে। আমরা ইন্টারনেটে পাওয়া যায় দোতারায় বাজানো লোকগান খুজতে গিয়ে খুব অল্প সংখ্যক গান খুজে পেয়েছি। দোতারা বাজাতে পারেন কিংবা দোতারায় এক্সপার্ট এমন লোকদের উপস্থিতি একদমই ছিল না বললেই চলে। এত শুন্যতার মাঝে ২০১৫ সালে হ্যামিলনের বাশিওয়ালার মত আবির্ভুত হন কানাডা প্রবাসী আমাদের সবার প্রিয় জুনায়েদ আনোয়ার চয়ন ভাই। ইউটিউবে তার একটি সাক্ষাতকারে দোতারা বাজনা দেখে আমরা মুগ্ধ হই।
জুনায়েদ ভাইয়ের বাজনার মধ্যে একটা মাদকতা আছে কারন মনে হয় তার হাতে দোতারা নিজেই গান হয়ে গাইতে শুরু করে। সেই থেকে আমাদের দোতারার প্রেমে পরা, আর সেই থেকে দোতারাকে নতুন করে আবিস্কার করার মিশন শুরু হয় আমাদের। সোশাল মিডিয়ার কল্যানে জুনায়েদ ভাইয়ের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় এবং সখ্যতা গড়ে ঊঠে। এরই মধ্য আমাদের মিশনে যুক্ত হন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী তারিক আহমেদ ভাই। প্রবাসে বসে লোকসংস্কৃতির চর্চার প্রতি ভালবাসা আমাদেরকেও নতুন কিছু ভাবার এবং উদ্যোগ নেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।
কোলকাতার বন্ধু সৌমেন্দু দাস ( তৎকালীন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী) দোতারা পছন্দ করে এমন মানুষদের সাথে পরিচিত হবার উদ্দেশ্যে ২০১৬ সালের ১৩ই এপ্রিল “দোতারা বাজাই” নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খোলার প্রস্তাব করেন। এই উদ্যোগকে একটি সফল কমিউনিটি প্লাটফর্ম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ঢাকার বন্ধু ফয়সাল রুপম এবং সাদ্দাম হোসেন সর্বাত্নক সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেন। ধীরে ধীরে দোতারা পছন্দ করেন এবং বাজাতে জানেন এমন বেশ কিছু বন্ধুর সাথে পরিচিত হই।
আমাদের এই কার্যক্রমের মধ্যে আমরা একটু বৈচিত্র আনার চেস্টা করি দুই ভাবে। প্রথমত ফেসবুক গ্রুপ সচল রাখার জন্য আমাদের আরো বেশী সংখ্যক ভলেন্টিয়ার যুক্ত করার চেস্টা করতে থাকি। দ্বিতীয়ত অনলাইন কার্যক্রমের বাইরে অফলাইনে আমাদের সদস্য এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাথে পরিচিত হবার চেস্টা করতে থাকি। আমাদের কার্যকরী পরিষদে নতুন সদস্য যুক্ত হতে থাকেন। এই সব কার্যক্রমের সাথে নতুন করে যুক্ত হয় দোতারা কর্মশালা এবং দোতারা আড্ডা। হাটি হাটি পা পা করে আমাদের আজকের দোতারা বাজাই।